রোববার , ০৫ অক্টোবর ২০২৫
Sunday , 05 October 2025
২০২৫৭ ২০২৫৩ ২০২৫১

স্পোর্টস ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৯:২৭, ২ অক্টোবর ২০২৫

বিসিবি নির্বাচন থেকে তামিম ইকবালের সরে দাঁড়ানোর নেপথ্যে

বিসিবি নির্বাচন থেকে তামিম ইকবালের সরে দাঁড়ানোর নেপথ্যে

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচন ঘিরে গত কয়েক দিন ধরেই পাল্টাপাল্টি অভিযোগের খবর শোনা যাচ্ছিল। এমন আলোচনার মধ্যে আবার গুঞ্জনও ছিল আলোচিত প্রার্থী সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে পারেন। শেষ পর্যন্ত সত্যিও হয়েছে সেই গুঞ্জন। 

মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে গতকাল (বুধবার) সকাল সোয়া দশটার দিকে বিসিবিতে গিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন তামিম। এসময় তিনি এবারের বিসিবি নির্বাচনকে 'ফিক্সিং' বা পাতানো নির্বাচন আখ্যা দিয়ে বললেন, "এই নির্বাচন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের জন্য একটা কালো দাগ হয়ে রইলো"। এসময় বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক ওপেনার বলেন, "যারা বোর্ডে আছেন, তারা চাইলে এভাবে নির্বাচন করতে পারেন, জিততেও পারেন। তবে ক্রিকেট আজ শতভাগ হেরে গেল"।

নির্বাচনে ‘সরকারি হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে’ প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘটনাও ঘটেছে। শেষ দিনে বিভিন্ন পদে ১৬ জন প্রার্থী প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ফলে অনেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এর ফলে জেলা-বিভাগের ক্যাটাগরিতে ১০টি পরিচালক পদে ছয়জন জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সংশ্লিষ্ট কয়েকজন সাবেক ক্রিকেটার এবং ক্রীড়া বিশ্লেষকের সাথে এ নিয়ে কথা হয়েছে। তারা বলছেন, বিসিবি নির্বাচন ঘিরে গত কয়েক দিনে দফায় দফায় পর্দার আড়ালে বিভিন্ন বৈঠক ও আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন তামিম ইকবাল নিজেও।

মঙ্গলবার দুপুরে তৃতীয় বিভাগ বাছাই ক্রিকেট থেকে উঠে আসা 'বিতর্কিত' ১৫টি ক্লাবের কোনো প্রতিনিধির নাম চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির কার্যক্রম স্থগিত করতে হাইকোর্ট নির্দেশনা দেয়। ক্রীড়া বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, মূলত ওই ১৫জন ক্লাব প্রতিনিধি ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়াই তামিম ইকবালের সরে দাঁড়ানোর অন্যতম একটি কারণ।

ক্রীড়া বিশ্লেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক এম এম কায়সার বলেন, "ক্রিকেট হেরে গেছে বলে তামিম ইকবাল মন্তব্য করলেও আমি মনে করি নির্বাচনের মতো একটা ছোট বিষয়ের সাথে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে মেলানোর কোনো মানে হয় না। এখানে ক্রিকেট হারেনি, নেগোসিয়েশনে তামিম ইকবাল হেরে গেছে"। আগামী ৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে এবারের বিসিবি নির্বাচন। এবার কাউন্সিলরের ভোটে বিভিন্ন ক্যাটাগরির ২৫ জন পরিচালক নির্বাচিত হবেন। আর তাদের ভোটেই বিসিবির নতুন সভাপতি ও সহ-সভাপতি নির্বাচন করা হবে।

চার বছর আগে ২০২১ সালের অক্টোবরেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল সর্বশেষ বিসিবি নির্বাচন। বুধবার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে পর বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে বিসিবির নির্বাচন কমিশন। বিসিবির বর্তমান সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুলও ক্যাটাগরি-১ এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। একই সাথে সভাপতি হিসেবে তিনি নির্বাচনে অংশ নেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন বুলবুল। তার বিরুদ্ধেই একই পদে লড়ার ঘোষণা আগে থেকেই দিয়েছিলেন তামিম ইকবাল। কিন্তু বুধবার সকালে এসেই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে তামিম এবারের বিসিবি নির্বাচন নিয়ে ক্ষোভের কথা প্রকাশ্যে আনেন।

বুধবার সকালে তামিম ইকবাল গণমাধ্যমে অভিযোগ করে বলেন, ‘আমিসহ ১৪-১৫ জনের মতো মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছি। শুরু থেকে বলে আসছি যে নির্বাচন কোন দিকে যাচ্ছে। যখন যেমন মনে হচ্ছে, যখন যা মনে হচ্ছে তখন তা করা হচ্ছে। এটা আসলে নির্বাচন নয়। ক্রিকেটের সাথে এটা কোনভাবে মানায় না।’ বাকি আরও যারা মনোনয়ন প্রত্যাহার করছে তাদের কথা উল্লেখ করে জাতীয় দলের সাবেক এই ওপেনার বলেন, ‘যখন ইসি তালিকা দেবে আজকে কারা কারা মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছে, তাদের নামগুলো দেখলেই আপনারা বুঝতে পারবেন যে তারা সবাই তাদের জায়গা থেকে হেভিওয়েট। তাদের ভোট ব্যাংক খুব স্ট্রং।’

‘এটা হচ্ছে আমাদের একটা প্রটেস্ট (প্রতিবাদ) যে, এই নোংরামির মধ্যে আমরা থাকতে পারবো না। এখানে ধরেন বিভিন্ন অনেক ধরনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে এই নোংরামির পার্ট (অংশ) আমরা হবো না’, বলছিলেন তামিম। বাংলাদেশের সাবেক এই অধিনায়ক এসময় দাবি করেন যে, নির্বাচনের পরিবেশ দেখে তিনি ছাড়াও আরও অনেকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদেরকে চাপ সৃষ্টি করে ভোটে রাখা হয়েছে। ‘এই যে পনেরো জনের মতো মনোনয়ন প্রত্যাহার করছে, এটা কিন্তু উল্লেখযোগ্য নম্বর। যারা বোর্ডে আছেন তারা যদি এভাবে করে নির্বাচন করতে চান করতে পারেন। জিততেও পারেন। কিন্তু আজকে ক্রিকেট হান্ড্রেড পার্সেন্ট হেরে গেছে, এটা নিয়ে সন্দেহ নাই’, বলছিলেন তামিম ইকবাল।

এক সময়ের জাতীয় দলের তারকা ক্রিকেটার এই সময়ে এসে ফিক্সিং বা পাতানো ভোটের অভিযোগ তুলে এই সংবাদ সম্মেলনেই দাবি করেছেন, এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে একদিকে যেমন ক্রিকেট হেরেছে ,অন্যদিকে তা ক্রিকেটে কালো দাগ লাগিয়েছে।

তামিম কেন সরে দাঁড়ালেন?

এবারের বিসিবি নির্বাচন নিয়ে নাটকীয়তা কিংবা রাজনীতি কম হয়নি। এ নিয়ে গত কয়েকদিন দেশে নানা আলোচনা-সমালোচনাও দেখা গেছে। বিসিবিতে নির্বাচিত হতে পর্দার আড়ালে যেমন আলোচনা হয়েছে, তেমনি প্রকাশ্যেও দেখা গেছে নানা মতবিরোধ। এই যেমন এবারের নির্বাচনে কারা নির্বাচিত হবেন তা নিয়ে বিএনপি ও অন্তর্বর্তী সরকারের ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের মধ্যে নানা আলোচনার খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

এবারের নির্বাচনে পরিচালক পদে ভোটে অংশ নিয়েছেন ক্রিকেট বোর্ড সংশ্লিষ্ট এমন একজন প্রার্থী দাবি করেছেন, গত কয়েক দিন এ নিয়ে বেশ কয়েক দফায় মিটিং হয়েছে। ভোটারদের প্রভাবিত করার ঘটনাও ঘটেছে। সে সব আলোচনায় কখনো কখনো তামিম ইকবাল নিজেও ছিলেন। নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরুর পর গত মাসে দুর্নীতি দমন কমিশনের বা দুদকের তদন্ত চলা ১৫টি ক্লাবকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিসিবির নির্বাচন কমিশন। নানা কারণে ওই ক্লাবগুলো বিতর্কিত ছিল বলেও বিসিবি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

যে কারণে খসড়া ভোটার তালিকা থেকে ওই ক্লাবগুলোকে বাদ দেওয়া হয়। পরে ক্লাবগুলো আবারও বিসিবি নির্বাচনে ভোটাধিকার ফেরত পেতে আদালতে আপিল করে ভোটার হিসেবে বৈধতা পায়। পরে গতকাল মঙ্গলবার ওই ক্লাবগুলোর ভোটাধিকারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ আপিল করেন সাবেক বিসিবি সভাপতি ও নির্বাচনে পরিচালক পদপ্রার্থী ফারুক আহমেদ। পরে হাইকোর্টের রায়ে আবারো ওই ১৫টি ক্লাবকে বাদ দেওয়া হয়।

বিসিবি সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা ও ক্রীড়া বিশ্লেষকদের সাথে এটি নিয়ে কথা বলে যতটুকু বোঝা গেছে, তার সারমর্ম অনেকটা এমন যে, মঙ্গলবার হাইকোর্টের রায়ের পরই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়টি অনেকেই ধারণা করছিলেন। এ নিয়ে নানা দেন-দরবার ও দফায় দফায় বৈঠকও হয়েছে গত সোম ও মঙ্গলবার। শেষ পর্যন্ত বুধবার সকালে মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন তামিম ইকবাল।

সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক এম এম কায়সার বলেন, ‘বাস্তবতা হলো তামিম এই নির্বাচনে জেতার জন্য এবং বড় চেয়ার পাওয়ার জন্য সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের সঙ্গে একধরনের সমঝোতা এবং ভাগাভাগির প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছিলেন। এনিয়ে গত সোমবার এবং মঙ্গলবার রাতে তারা লম্বা সময়জুড়ে বৈঠক করেছিলেন। শুরুতে সেই বৈঠকে উভয়পক্ষের হাসিমুখ থাকলেও শেষপর্যন্ত আর আর স্থায়ী হয়নি। কারণ ভাগবণ্টনের সমঝোতা যে হলো না।’

অন্যদিকে, এই নির্বাচনে বিএনপির চারজন নেতার ছেলেরা প্রার্থীও হয়েছেন। সরকারের সাথে সেটি নিয়ে পর্দার অন্তরালে এক ধরনের সমঝোতার খবরও প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। কায়সার বলছিলেন, ‘তামিম তার প্যানেলে বিএনপির ‘‘পলিটিক্যাল কিডসদের’’ জায়গা দিতে গিয়ে ক্লাবের অনেক পরীক্ষিত এবং তার সমর্থনে এতদিন স্লোগান তোলা ক্রিকেট সংগঠকদের জায়গা দিতে পারেননি। নিজের প্যানেলে এ নিয়ে তামিমকে বড় সঙ্কটে পড়তে হয়েছিল। অন্যদিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া সরকার সমর্থিত পক্ষের সঙ্গে সমঝোতাও শেষ পর্যন্ত না হওয়ায় চারদিকের তুমুল চাপের মধ্যে পড়তে হয় তামিমকে"। তার মতে, তামিম সত্যিকার অর্থে এই নির্বাচনে বিরুদ্ধপক্ষের সঙ্গে সমঝোতায় বা ভাগাভাগিতে এবং নিজের প্যানেল সাজানোর পরিকল্পনায় হেরে গিয়েই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।

তিন ক্যাটাগরিতে ৩৩ প্রার্থী

আগামী সোমবার অনুষ্ঠিতব্য বিসিবি নির্বাচনে তিনটি ক্যাটাগরিতে ২৫টি পরিচালক পদের বিপরীতে নির্বাচনে অংশ নেবেন ৩৩জন প্রার্থী। গতকাল বুধবার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর যাচাই বাছাই ও শুনানি শেষে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা শেখ জোবায়েদ হোসেন। সোমবার তামিম ইকবাল ছাড়াও এই নির্বাচনের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন আরো ১৫জন। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর যে ৩৩জন প্রার্থী রয়েছেন, তাদেরই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন ১৯০জন কাউন্সিলর।

চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় নাম ছিল ৫০ জনের। সেখান থেকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন ১৬ জন। জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা নিয়ে গঠিত ক্যাটাগরি-১ থেকে নির্বাচিত হবেন মোট ১০ জন পরিচালক। এই ক্যাটাগরিতে জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা থেকে আসা ৭১ জন কাউন্সিলরই ভোটার হওয়ার কথা থাকলেও নরসিংদী জেলা ক্রীড়া সংস্থা থেকে কোনো কাউন্সিলর না থাকায় ভোটার এখন ৭০ জন। জেলা-বিভাগের ক্যাটাগরিতে ১০ পরিচালকের ৬ জনই অবশ্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন।

প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় খুলনা বিভাগ থেকে আগেই পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার ও সাবেক নির্বাচক আব্দুর রাজ্জাক এবং জুলফিকার আলী খান। বরিশাল থেকে শাখাওয়াত হোসেন এবং সিলেটের রাহাত সামসও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আগেই নির্বাচিত হয়েছেন। সাবেক ক্রিকেটার ও জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন সংস্থা নিয়ে ক্যাটাগরি-৩–এ মোট ভোটার ৪৫ জন। তাদের ভোটে নির্বাচিত হবেন একজন পরিচালক।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজউদ্দিন মো. আলমগীর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করায় এই ক্যাটাগরিতে প্রার্থী আছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সিলর দেবব্রত পাল ও সাবেক ক্রিকেটার খালেদ মাসুদ। এবারের বিসিবি নির্বাচনে কাউন্সিলরের ভোটে বিভিন্ন ক্যাটাগরির পরিচালক নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের ভোটেই বিসিবির নতুন সভাপতি ও সহ-সভাপতিও নির্বাচিত হবে।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়