নিয়ম রক্ষার এনসিএল থেকে প্রাপ্তি সামান্যই

বাংলাদেশ ২০০৬ সাল থেকে টি-টোয়েন্টি খেলছে, ২০০৭-এর বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ৯টি বিশ্বকাপ খেলে ফেলেছে, এশিয়া কাপের তিনটি টি-টোয়েন্টি সংস্করণেও খেলেছে, কিন্তু এত আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার পরও যোগফল শূন্যের কাছাকাছি। খেলোয়াড়দের অভিযোগ, তারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের বাইরে টি-টোয়েন্টি খেলার সুযোগ পান না, আর বিপিএলে পেলেও বিদেশিদের ওপর ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর অতিনির্ভরতায় পর্যাপ্ত এক্সপোজার পান না। তাই স্থানীয় ক্রিকেটারদের নিয়ে একটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের আয়োজন ফিরে এলো ক্রিকেটের বর্ষপঞ্জিতে। তবে সঠিক উপাদান আর অনুপান না হলে যেমন রান্না ভালো হয় না, তেমনি অসময়ে আয়োজন, দীর্ঘসূত্রতা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় এনসিএল থেকে প্রাপ্তি সামান্যই।
আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় টানা দ্বিতীয় বছর আয়োজন করা হয়েছে এনসিএল টি-২০। শুরুতে রাজশাহী আর বগুড়ায় কিছু ম্যাচ আয়োজনের পর সিলেটে বাকি ম্যাচগুলো আয়োজনের পরিকল্পনা থাকলেও বৃষ্টির কারণে শুরুতেই স্থগিত হয়ে যায় টুর্নামেন্ট। এরপর আবহাওয়ার অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় পুরো টুর্নামেন্টই সরিয়ে আনা হয় সিলেটে। একই সময়ে জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা এশিয়া কাপ এবং আফগানিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ও ওডিআই সিরিজ খেলতে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। বাংলাদেশ জাতীয় দলে থাকা ক্রিকেটাররাই টি-টোয়েন্টিতে খুব একটা উঁচু মানের নন, তাদের বাইরে যারা আছেন তাদের মানটাও অনেক নিচের স্তরে। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। খেলাগুলো খুব একটা উত্তেজনাকর, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও রোমাঞ্চকর হয়নি। দেখা যায়নি চার ছক্কার হইচই, বড় রান তাড়া করে শেষ ওভারে এসে জেতার মতো রোমাঞ্চের জন্ম হয়নি। দেখা গেছে ম্যাড়ম্যাড়ে, স্বাদহীন কিছু নিয়ম রক্ষার টি-টোয়েন্টি ম্যাচের, যেসব দেখতে মাঠেও খুব একটা দর্শক আসেনি, আর গণমাধ্যমের চোখও এড়িয়ে গেছে এশিয়া কাপ এবং বিসিবি নির্বাচনের ডামাডোলে।
এবারের এনসিএল ছিল এমন একটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট যেখানে দুটো সেঞ্চুরিই করেছেন বাংলাদেশের দুই টেস্ট ওপেনার! একবাক্যে এভাবেই বলা যায় আসরটিকে। দুটো সেঞ্চুরি হয়েছে ২৪ ম্যাচের আসরে; করেছেন সাদমান ইসলাম আর মাহমুদুল হাসান জয় যারা কেউই টি-টোয়েন্টি দলের ধারেকাছেও নেই। খুব উঁচু স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিং করেছেন এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে দ্বিতীয় নামটি মাহমুদউল্লাহর! টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা দেওয়া মাহমুদউল্লাহ এই শেষবেলাতেও ২২ বলে ৪১* রান করতে পারেন। পরের নামটা খালেদ আহমেদের, টেস্ট দলের পেস বোলার। স্ট্রাইকরেট ১৭৫, তবে যখন দেখবেন চার ইনিংসে মোট রান ৪২ এবং সর্বোচ্চ রান ২৬ তখন বুঝে যাবেন পরিসংখ্যান কতটা ধোঁয়াশা তৈরি করে। সর্বোচ্চ স্ট্রাইকরেটে পরের নামটা সুমন খানের, মানিকগঞ্জের এই পেসার একটা ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি ম্যাচে পাঁচ উইকেট নিয়ে খানিকটা নাম কামিয়েছিলেন। তার ব্যাটিং নিয়ে খুব একটা সুনাম শোনা যায় না, চার ইনিংসে ২৪ বলে ৩৯ রান, যেখানে সর্বোচ্চ ইনিংসটি ২১ রানের, এ নিয়েই সুমন খান শীর্ষ পাঁচে!
সর্বোচ্চ রান মাহমুদুল হাসান জয়ের, দুটো হাফসেঞ্চুরি আর এক সেঞ্চুরিতে ৮ ম্যাচে ৩২৩, স্ট্রাইকরেট ১৫৫। অথচ জাতীয় দলের হয়ে বহু টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলা ক্রিকেটাররা এই ভেতো এনসিএলেও রান করতে খাবি খাচ্ছেন। নাঈম শেখ দেশের হয়ে খেলেছেন ৩৮টি টি-টোয়েন্টি, কিছুদিন আগেও ছিলেন জাতীয় দলে। তার রান চার ম্যাচে ১২২, স্ট্রাইকরেট সেই আগের মতোই ১২৭। নাজমুল হোসেন শান্ত ছিলেন টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক, এখন অবশ্য নেতৃত্ব হারিয়ে জায়গাও হারিয়েছেন। ৫০টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলা শান্ত চার ম্যাচে করেছেন ৯২ রান, স্ট্রাইকরেট ১৩৩। সৌম্য সরকার ভিসা না পাওয়ায় যেতে পারলেন না আফগানিস্তান সিরিজে খেলতে। ফাইনালে খেলেছেন ২২ বলে ৮ রানের ইনিংস, সেটাও ইনিংসের সূচনায় নেমে, ইনিংসের বেশিরভাগ সময়টাই খেলেছেন পাওয়ার প্লের ভেতর। এমন ইনিংস দলকে ডোবানোর জন্য যথেষ্ট। গোটা আসরে ২০০ ছাড়ানো দলীয় সংগ্রহ দেখা গেছে মাত্র দুটো ইনিংসে। সিলেটের বিপক্ষে চট্টগ্রামের ২১৪ আর রাজশাহীর ২০০। ঢাকা মেট্রোর ১৮৫ রান তাড়া করে চট্টগ্রামের ৮ উইকেটে জেতাটাই রান তাড়ায় সেরা।
বোলিংয়ে ঘুরে-ফিরে সেই বামহাতি স্পিনারদেরই সাফল্য। যদিও ঘরোয়াতে বিস্তর বামহাতি স্পিনারদের খেলেও আন্তর্জাতিক ম্যাচে অক্ষর প্যাটেলদের মতো বামহাতি স্পিনারদের সামলাতে হিমশিম খান বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। শীর্ষ উইকেটশিকারির তালিকায় ওপরের দুটো নাম হাসান মুরাদ ও আবু হাশিম। তিন নম্বর নামটা এক অফস্পিনারের, শেখ পারভেজ জীবন।
টেস্ট এবং ওয়ানডের বাইরে টি-টোয়েন্টি সংস্করণটার আবিষ্কার মূলত বাণিজ্যিক কারণে। ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের মার্কেটিং ম্যানেজার স্টুয়ার্ট রবিনসন এই ধারণার জনক, মূলত তরুণ দর্শকদের ক্রিকেটে আগ্রহ বাড়াতেই সংক্ষিপ্ত এই সংস্করণের উদ্ভাবন। যাতে করে খেলাটা আরও উত্তেজনাপূর্ণ, রোমাঞ্চকম হয়, কাজকর্মের শেষে ঘণ্টা তিনেক খেলা দেখে ঘরে ফেরার আগে দর্শকরা যেন বিনোদন নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন, যেখানে অন্য দুই সংস্করণে একটা দিনের প্রায় অর্ধেকটা সময়ই চলে যায়। এনসিএলে টি-টোয়েন্টির মৌলিক দর্শনই অনুপস্থিত। কর্মদিবসের দিনেরবেলায় খেলা, এমনকি ফাইনালটাও হলো না ছুটির দিনে। স্পন্সর ব্যাংক বলেই বোধহয় ব্যাংক বন্ধের দিনে খেলাও বন্ধ! বিনোদন নেই, তারকাদের উপস্থিতি নেই, খেলাতেও নেই রোমাঞ্চ কিংবা উত্তেজনা। এই খেলা দর্শক কেন টিকিট কেটে দেখবে?
তবে প্রাপ্তিযোগ ক্রিকেটারদের। এই ম্যাড়ম্যাড়ে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেই প্রতি ম্যাচে ৪০ হাজার টাকা করে পেয়েছেন তারা, যেটা আগের মৌসুমে ছিল ২৫ হাজার। এজন্য আকরাম খানকে তারা ধন্যবাদ দিতেই পারেন, তিনিই টুর্নামেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে আসরটা শুরু করে দিয়েছিলেন। আর শেষ হতে হতে বিসিবিতেই আর নেই এই সাবেক অধিনায়ক।