বিসিসিআই + ইসিবি + সিএ = বিসিবি!

গত বছর বিসিবি সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর কয়েক মাসেও কার্যকরী স্থায়ী কমিটি দিতে পারছিলেন না ফারুক আহমেদ। কারণ হিসেবে তখন জানিয়েছিলেন, রাজনৈতিক পটভূমিকায় বেশ কজন পরিচালক পদত্যাগ করে চলে যাওয়ায় অল্প লোক দিয়ে চলছেন তিনি। তাই কমিটিগুলো সাজাতে পারছেন না। তখনো তার বোর্ডে পরিচালক হিসেবে ছিলেন ১০ জন। বর্তমান সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল নতুন মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, কাজের চাপে তারা হয়রান, ২৪ ঘণ্টার বদলে দিনটা ৩৩ ঘণ্টা হলে নাকি সুবিধা হতো।
২৫ সদস্যের পূর্ণ বোর্ডের মাত্র দুই-পঞ্চমাংশ নিয়ে বোর্ড চালানোর কষ্টের কথা ফারুক বারবার বলেছেন। তবে মাত্র ৪০ শতাংশ সদস্য নিয়েও ফারুকের নেতৃত্বাধীন বিসিবিতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মানুষের সংখ্যা শ্রীলঙ্কা, নিউজিল্যান্ড, আফগানিস্তান, এমনকি ক্রিকেট পরাশক্তি ভারতের বোর্ডের তুলনায়ও বেশি ছিল।
বিসিসিআই + ইসিবি + সিএ = বিসিবি
শেষ পর্যন্ত ফারুক বোর্ড থেকে বাদ পড়লেও সাম্প্রতিক বিসিবি নির্বাচনে নাটকীয়ভাবে ফিরে এসেছেন। ৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি নবনির্বাচিত সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুলের নেতৃত্বাধীন বোর্ডের দুই সহ-সভাপতির একজন তিনি।
ফারুকের মতো খর্ব বোর্ড নয়, বুলবুল পেয়েছেন প্রায় পূর্ণাঙ্গ একটি বোর্ড—নির্বাচনে ২৩ পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন, বাকি দুজনকে মনোনীত করেছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)। যদিও একজন—ইশফাক আহসান—নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তাকে শিগগিরই বদল করা হবে বলে ধারণা।
২৫ সদস্য নিয়ে বুলবুল এখন সব টেস্ট খেলুড়ে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় পরিচালনা পর্ষদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন—যা অধিকাংশ বোর্ডের দ্বিগুণ, কিছু ক্ষেত্রে তিনগুণ বড়।
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই)-এর সদস্য সংখ্যা মাত্র ৮। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ)-এর ১০ পরিচালক, আর ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডে (ইসিবি) ১১ জন—যার মধ্যে দুইজন পূর্ণকালীন বেতনভুক্ত কর্মকর্তা, সিইও ও সিএফও। তাদের বাদ দিলে নীতিনির্ধারণী ভূমিকায় রয়েছেন মাত্র ৯ জন।
সব মিলিয়ে, ক্রিকেটের তথাকথিত 'বিগ থ্রি'—বিসিসিআই, ইসিবি, সিএ—তিনটি বোর্ডে মোট ২৭ জন নীতিনির্ধারক আছেন, যা বাংলাদেশের চেয়ে মাত্র দুইজন বেশি।
নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডে ৮ সদস্য, ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকায় (সিএসএ) ১৩ জন (দুই নির্বাহী বাদে), আর বহুজাতিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী ক্রিকেট ওয়েস্ট ইন্ডিজ (সিডব্লিউআই)-এর ১০ জন পরিচালক।
এমনকি রাজনৈতিক কারণে বিসিবির মতো আলোচনায় থাকা পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) ও শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট (এসএলসি)-এর বোর্ডেও সদস্য সংখ্যা যথাক্রমে ১১ ও ৭।
জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে (জেডসি) ১২, ক্রিকেট আয়ারল্যান্ডে (সিআই) ১৪, আর আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডে (এসিবি) ৮ জন পরিচালক আছেন।
এমন না যে বাকিদের চেয়ে বাংলাদেশ দল পারফরম্যান্সে এগিয়ে। বাংলাদেশ পুরুষ দলের কথাই ধরা যাক। টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে তার নয়ে, ওয়ানডেতে গত কয়েক মাস ধরে দশে, টি-টোয়েন্টিতে নয়ে।
পারফরম্যান্স ও বোর্ডের নেতৃত্বের বহরে মিল নেই। গত কয়েকদিন আগে সেই নেতৃত্ব নির্বাচনে চরম বিতর্কিত এক প্রক্রিয়া দেখা গেছে বিসিবিতে। বোর্ড পরিচালক হতে আগ্রহীদের ভেতর দ্বন্দ্ব, সরকারি হস্তক্ষেপ, বিব্রতকর কাঁদা ছোড়াছুড়িতে নেতিবাচক খবরে এসেছে বিসিবি। শেষ পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে দায়িত্ব নিয়েছেন নতুন পরিচালকরা।
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিসিবির পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা বেতনভুক্ত নন, কিন্তু এই পদ পেতে চাকরি ছেড়ে আসতেও দেখা গেছে। জাতীয় পুরুষ দলের নির্বাচক হিসেবে কাজ করা এক সাবেক ক্রিকেটার মোটা অঙ্কের সম্মানী ছেড়ে বিনা বেতনের পরিচালক হয়েছেন।
নামে, ভারে, পারফরম্যান্সে, কাজের বিস্তৃতিতে দুনিয়ার সেরা সেরা ক্রিকেট বোর্ডগুলো যেখানে ৮, ৯ জন পলিসি মেকার দিয়ে চলছে। বিসিবিতে এত বড় বহর কি আসলেই প্রয়োজনীয়, এই প্রশ্ন এখন জোরালো।
বিসিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলে উঁচু পদে কাজ করা সৈয়দ আশরাফুল হক দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপে এত বড় বোর্ডের প্রয়োজন দেখছেন না, 'আমার তো মনে হয় না এত বড় বোর্ড জরুরি। কারণ বোর্ড অফ ডিরেক্টরস সিদ্ধান্ত দেবে ক্রিকেট কোন দিকে যাবে, প্রয়োগ করার দায়িত্বটা প্রফেশনালদের। এখানে সবগুলো দেশের বোর্ডই ছোট ছোট। এমনকি এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের যে বডি ছিলো, যেখানে আমি কাজ করেছি। সেখানে চারটা টেস্ট খেলুড়ে দেশের চারজন (এখন পাঁচ), আরও চারজন। মানে ৮ জন মিলে বোর্ড ছিলো। এরাই সিদ্ধান্ত নিত পুরো এশিয়ার ক্রিকেট কীভাবে চলবে। আমাদের দেশে ২৫ জন কেন প্রয়োজন আমি জানি না, আমার মনে হয় সংখ্যাটা বেশি।'
নারী প্রতিনিধিত্বে পেছনের দিকে বিসিবি
বিসিবির নেতৃত্বে যখনই যারা এসেছেন তাদের বেশিরভাগ ছিলেন ব্যবসায়ী, পাশাপাশি ক্রীড়া সংগঠক। কেউ কেউ সাবেক খেলোয়াড়। ক্রিকেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না এমন অনেককেও দেখা গেছে, বর্তমান বোর্ডেও এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। তবে নেতৃত্বের বা নীতি নির্ধারণী জায়গায় নারী প্রতিনিধির ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। বিসিবির ইতিহাসে নারী পরিচালক ছিলেন একজনই। ২০০৭-০৮ সালের বোর্ডে পরিচালক হয়েছিলেন সাবেক নারী ক্রিকেটার মনোয়ারা আনিস মিনু। বর্তমান বোর্ডেও একজন নারীকে যুক্ত করার কথা শোনা যাচ্ছে।
কিন্তু বড় ক্রিকেট জাতীর বোর্ডগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী প্রতিনিধিত্ব দেখা যায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট। তাদের বোর্ডের সভাপতি একজন নারী, নির্বাহী চেয়ারেও আছেন এক নারী। তারা সহ ৮ জনের পরিচালনা পর্ষদে পাঁচজনই নারী।
দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ডেও সভাপতি পদে আছেন নারী। ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের গঠনতন্ত্রে ৫০ ভাগ নারী বোর্ড ও নির্বাহী পর্ষদে নেতৃত্বের কথা বলা আছে। তাদের দুই নির্বাহী কর্মকর্তা ছাড়া বাকি ৯ পরিচালকের ৫ জনই নারী। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার পরিচালকদের তিনজন নারী।
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডে ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশন থেকে দুজন প্রতিনিধি নেওয়া হয়। তার একজন পুরুষ ও একজন থাকেন নারী। এমনকি সবচেয়ে নতুন টেস্ট খেলুড়ে দল আয়ারল্যান্ডের বর্তমান সভাপতি একজন নারী। এর বাইরে আরও তিন পরিচালক আছেন নারী।
স্বচ্ছতা? অন্য বোর্ডে আছে
বেশিরভাগ বড় ক্রিকেট বোর্ডে পরিচালকদের সম্মানী ও আর্থিক সুবিধার বিষয়গুলো প্রকাশ্য। যেমন, অস্ট্রেলিয়ার পরিচালকরা বার্ষিক সম্মানী পান, যার সঠিক অঙ্কও ওয়েবসাইটে উল্লেখ থাকে।
বেতনভুক্ত নির্বাহীদের—যেমন সিইও ও সিএফও—বেতনও প্রকাশ করা হয়।
বিসিসিআইয়ের নীতিনির্ধারকরা সম্মানী-ভিত্তিক হলেও তাদের সুবিধা ও দায়িত্ব স্পষ্টভাবে নির্ধারিত এবং স্বচ্ছ।
কিন্তু বিসিবিতে বিষয়টি তেমন নয়। সংবিধান অনুযায়ী পরিচালকরা বেতনভুক্ত নন, তবুও কেউ কেউ তাদের পূর্বের চাকরি ছেড়ে দেন এই "বিনা বেতনের" পদে কাজ করার জন্য।
সাম্প্রতিক নির্বাচনে একজন সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার, যিনি নির্বাচক হিসেবে ভালো সম্মানী পেতেন, তিনি সেই পদ ছেড়ে বিনা বেতনের পরিচালক হয়েছেন। সূত্র: ডেইলি স্টার